মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২


আজ ভাষা নামে মেয়েটির শুভ জন্মদিন

স্যার স্যার পিছন থেকে ডেকে উঠে এক কিশোরী মেয়ে,
ফুল নিবেন ফুল,আজ না একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস,
নিন একগুচ্ছ হলুদ রাঙা গাঁদা ফুল,ওই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসুন,
টাকা লাগবো না; আজ ফুল বিক্রি করতে এই শহীদ মিনারে আসিনি,
এসেছি ঝাকরা চুলের শব্দ সৃষ্টির কবিদের হাতে একগুচ্ছ করে ফুল তুলে দিতে,
নিন,আপনি তো কবি;২১ শতাব্দির অহংকার,সাহিত্যের রুপকার;
তোমার নাম কি বলো তো?
ভাষা,
ভাষা?
হ্যাঁ ভাষা আমার নাম। আমার আব্বু-আম্মু নামটি রেখেছিল এই দিনটির জন্য,
তার মানে একুশ ফেব্রুয়ারিতে তোমার জন্ম?
তাহলে তো আজ তোমার জন্মদিন,
জ্বি স্যার,
শুভ জন্মদিন ভাষা;
ধন্যবাদ স্যার,আপনার আর্শীবাদ পৃথিবীর শ্রেষ্ট উপহার।
সময়ে পেরিয়ে যাচ্ছে স্যার নিন তো ফুলগুলো,
ওই শহীদ মিনারে আগে তা অর্পনে শ্রদ্ধাবিনয় করে আসুন,
তারপর আপনার সাথে কিছুক্ষন মন খুলে কথা বলি-
তুমি আমাকে চিনো?
জ্বি স্যার,আপনি হলেন কাব্যগল্পকার ও প্রবন্ধকার সালেহ আহমেদ,
থাকেন প্রান্তিক সীমায়,পাশেই আপনার জেমকনের কমলা বাগান,
তারপাশেই সবুজ প্রান্তর বিস্তৃত চা-বাগান,
বাসার উঠোনে একটা বকুল ফুলের গাছ আছে,
কোন কোন চাঁদনী রাতে উঠোনে বসে মুগ্ধ হয়ে হিমু হয়ে জোস্না দেখেন,
কখনো হিমালিয়া আপার সাথে মুঠোফোনে গল্পে মেতে উঠেন,
উঠোনে দাঁড়ানো বকুল গাছটি থেকে ঝরঝর করে পরে ফুলগুলো,
আপনি সে ফুলগুলোর সাথে কিছু জোনাকি ধরার চেষ্টা করেন,ঠিক না?
এতো কিছু তুমি জানো কি করে?
আপনার কাব্যগল্প পড়ে,রিভার-চন্দ্রমল্লিকা-হিমালিয়া সিরিজ পড়ে,যান তো স্যার,
ফুলগুলো দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসুন,
আমি এগিয়ে চলি শহীদ মিনারের দিকে,
ওই উড়ন্ত পতাকার মাঝে পটপট করে গেয়ে চলেছে শব্দের ঢেউ তুলে,
অমৃত শহীদদের কন্ঠস্বর,
পতাকার মাঝে নিভৃতে শুনতে চেষ্টা করি।

আমি নগ্ন পায়ে হেটে এসেছি এতটা দূর,
সামনেই শহীদ মিনার,ফুলে ফুলে সেজেছে অপরুপতায়,
বুকে শোক দিবসের কালো ব্যাজ,মনে বড় ব্যথা,হারানো কষ্ট,
চোখ ভিঁজে আসে বুক নড়ে চড়ে জেগে উঠে অকৃত্রিম এক ভালবাসায়,
কন্ঠস্বরে জেগে উঠে ‘আ-মরি বাংলা ভাষা,তুমি আমার প্রাণের ভাষা’—
তোমার ভাষায় লিখতে পারি,গাইতে পারি,আমার মায়ের গর্ব তুমি,
জীবন হারিয়েছি,রক্ত দিয়েছি,ভিজিয়েছি সবুজ বাংলার রাজপথ খানি,
তোমার জন্য লড়েছি রাজপথে,স্লোগানে স্লোগানে কন্ঠ ফাটিয়ে জানিয়েছি,
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা,তুমি ছাড়া আর কিছু চাই না;
তোমার ভাষায় বলবো কথা;জানিয়ে দিব বাংলাই আমার শ্রেষ্ঠ ভাষা’
শহীদ মিনারে দু’হাত দিয়ে রাখি ভাষার দেওয়া একগুচ্ছ হলুদ গাঁদা ফূল,
কিসের এক অদৃশ্য আওয়াজে ভেসে উঠে ‘জেগে আছি আমরা শহীদের আত্না,
এই বাংলায়,তোমাদের ভাষায়,এই প্রিয় ভাষা বাংলায়,
লিখে রাখ এই অদৃশ্য শহীদ বাংলার অদৃশ্যের আত্নার আওয়াজ’
আমিও গেয়ে উঠি-‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদের স্মরনে..
আমার এ হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে….।

স্যার কাঁদছেন পিছন থেকে গায়ের কোটটা হালকা টেনে বলে ভাষা মেয়েটি
হ্যাঁ মা,এই স্মৃতি স্তম্ভ দেখে আবেগ-অনুভুতির জোয়ারে চোখের জল চলে এলো,
আসুন স্যার,এখানে থাকলে আপনার চোখে আষাঢ়ের বন্যার স্রোতে প্লাবিত হবে,
ওই যে দেখা যায় মাঠের শেষ প্রান্তে শিশু গাছ,চলুন ওখানে গিয়ে বসি,
বসে কি হবে?
আপনার সাথে মন খুলে কিছুক্ষণ কথা বলবো একান্ত আপনজনের মতো।
চলো—
আমরা হাটতে থাকি শিশু গাছটির দিকে লক্ষ্য করে,
জানিনা এই কিশোরী ৮ বছরের মেয়েটি আমাকে কি গল্প শুনাতে চাচ্ছে?
স্যার আমাকে দুটো বেলুন কিনে দিবেন? এই নিন বিশ টাকা,
আমি নিজেও কিনতে পারতাম,কিন্তু কিনবো না;
কেন?
আপনার হাত থেকে আমি তা গ্রহণ করবো,কিনে দিবেন না স্যার?
আমি বেলুন কিনে দেই,ভাষা আপ্লুত হয়ে বাবার কোলে মিশতে চায়,
বুকের কাছে টেনে নিয়ে আদর করি,অস্পষ্টভাবে শুনতে পাই আব্বু আব্বু—
আমি পুলকিত হই,হৃদয় আবার বাঁধ ভাঙার জোয়ারে প্লাবিত হয়,
ডান হস্ত দিয়ে মাথা বুলিয়ে ছড়িয়ে দেই পিতৃত্বের স্নেহের আদর,
মেয়েটি অবুঝ প্রাণীর মতো আদরের পরশে মিশে যেতে চায় প্রেমাত্নায়।

নি:সঙ্গ শিশু গাছ,আশপাশে হালকা সবুজ-হলুদ রঙে মাঠের ঘাস
মুখোমুখি বসি আমি আর কিশোরী ভাষা নামে মেয়েটি,
জিজ্ঞেস করি-আচ্ছা ভাষা তোমার বাসায় কে কে আছেন?
কেউ নেই স্যার,বছর পাঁচেক আগে আব্বু-আম্মুকে কে কারা খুন করে,
তখন আমার বয়স সবে মাত্র তিনবছর,
যা এইতো কিছুদিন আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যায়,
তাদের ছেলে মেঘের যা হয়েছে—
তুমি কি খবরের কাগজ পড়ো?
পড়ি,তবে লুকিয়ে লুকিয়ে,আমার দাদীমার কঠোর শাসন,
টিভি দেখা যাবে না;সারাক্ষন পড়া আর পড়া,
আমাকে নাকি সাংবাদিক বানাবেন,দূর্জয় কলম সৈনিক,
একদিন কলমের অপার শক্তিতে ফাসিতে ঝুলাতে চাই ওই সব হত্যাকারীদের,
এক ফেব্রুয়ারি ভোরেই ওরা আব্বু-আম্মুক খুন করে,
পালিয়ে যায় কালো মুখোস পরে নোংড়া জানোয়ার হয়ে,
আমি দূর্জয় কলম সৈনিক হতে চাই স্যার,আমি কি পারবো না?
পারবে ভাষা,তোমাকে পারতেই হবে,
কিন্তু কিভাবে?
আমি তোমাকে বানাবো সেই দূর্জয় কলম সৈনিক?
আব্বু! স্যরি স্যার,
স্যরি কেন? আরেকবার বলো ভাষা,কি যেন বললে—
আব্বু!
চলতো মা ওই যে পতাকার আওয়াজে কি শুনা যাচ্ছে শুনে আসি,
আব্বু আমিও শুনতে পাচ্ছি—
কি?
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি,
চিরদিন তোমার আকাশ,তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’।

Print this post

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন