সোমবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১২

ইন্টারনেট সেবার বেহাল দশা


রোকনুজ্জামান রাকিব

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০-৪০ লাখ পৌঁছেছে। ২০০৮ সালে সংখ্যা ছিল ছয় লাখ। এখন দেশে ১০০ জনের মধ্যে দুই থেকে তিন জন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বর্তমানে দেশে প্রায় কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক আছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও ইন্টারনেট ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইন্টারনেট সেবাকে জনপ্রিয় করতে মোবাইল ফোনই বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের পাশাপাশি ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবাও জনপ্রিয় হচ্ছে। বর্তমানে দেশে লাখের বেশি ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। কিউবি বাংলালায়ন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান ওয়াইম্যাক্স সেবা দিচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের উপজেলাতেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে বাংলাদেশ টেলকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) 
 আশা করা যাচ্ছে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটিতে উন্নীত হবে, যা হবে জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্র তেমনভাবে প্রসার লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশের শহর কিংবা গ্রামে পরিপূর্ণভাবে ইন্টারনেট সেবা কোনো প্রতিষ্ঠানই ঠিকমত দিতে পারছে না। মূলত ইন্টারনেট ব্যবহারের যে ব্যবস্থাগুলো বর্তমানে চালু আছে সেগুলোর অসুবিধা আছে অনেক। নানা অসুবিধার কারনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়লেও তারা ব্যবহারে সন্তুষ্ট নয়।

স্পিড কম
ইন্টারনেটে যারা দিনের অনেকটা সময় কাজ করেন তাদের প্রায় সবারই অভিযোগবাংলাদেশে ইন্টারনেটে স্পিড খুবই কম। বাংলাদেশে মুহূর্তে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ১০ লাখ। ঢাকায় যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাদের কথা না বললেও এটা অবাক করার মতো ব্যাপার যে, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে ফেসবুকের মতো ওয়েবসাইট ওপেন করতে অনেক অনেক বেশি সময় লাগে। নিয়ে কিছুদিন আগে মানববন্ধন পর্যন্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইন্টারনেটে ডাউনলোডসহ বাকি কাজ কীভাবে সম্ভব এটা সহজেই অনুমেয়।

মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট
মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে সিম ব্যবহার করে এই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশে চালু ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে জিপিআরএস এবং এজ। তুলনামূলক দ্রুতগতির এজ সেবা সবার নেই। অনেক দেশে মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে ওয়াই-ফাই এবং থ্রিজি পদ্ধতিতে সেবা দেয়া হলেও বাংলাদেশে দুটির কোনোটিই নেই। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য সুবিধাজনক হলো, সিম কিনে নিজেই ইন্টারনেট চালু করা যায়। ডাটার পরিমাণ (কিলোবাইট) হিসেবে অথবা মাসিক হিসেবে অর্থ দিতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এতে খরচ অত্যন্ত বেশি। মোবাইল কোম্পানিগুলোর ছোট ছোট যে প্যাকেজ রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করেও গ্রাহকরা সন্তুষ্ট নয়। সেই সঙ্গে ইন্টারনেটের গতি তুলনামূলক ধীর। বর্তমানে ছবি সংবলিত অনেক ওয়েবসাইট ওপেন করার জন্য কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। ভিডিও দেখার প্রশ্নই আসে না।

ওয়াইম্যাক্স
বাংলাদেশে দুটি কোম্পানি বাংলালায়ন কিউবি ওয়াইম্যাক্স সেবা দিচ্ছে। চালু হওয়ার আগে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করলেও খরচের কারণে ব্যবহারকারীর সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। বিশেষ করে বিভাগীয় কয়েকটি শহর ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ শহর বা জেলা শহরে এই ওয়াইম্যাক্স সুবিধা নেই। ঢাকা শহর ছাড়া অন্যান্য জায়গায় এর গ্রাহক সংখ্যাও কম। বর্তমানে মডেমের দাম এবং ডাটার ব্যবহার, গতি ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে আনার পর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও ভোগান্তির শেষ নেই। সঙ্গে কমছে সেবার মান। সেবায় প্রায়ই নেটওয়ার্ক না পাওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তবে ওয়াইম্যাক্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, কাঙ্ক্ষিত ইন্টারনেট স্পিড না পাওয়া সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিক্রয়-পরবর্তী সঠিক সেবা না পাওয়া। নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলেও কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে কোনো সমাধান দিতে পারছে না। দিন দিন অভিযোগের পাল্লাই ভারি হচ্ছে।

ওয়াই-ফাই
বর্তমানে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এমনকি ডিজিটাল ক্যামেরায় ওয়াইফাই কানেকটিভির সুযোগ থাকায় এই সেবা সহজ হতে পারত, কিন্তু কাভারেজ না থাকার কারণে ব্যবহারকারী তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর আবাসিক হলগুলোতে ওয়াইফাই সুবিধা দেয়া হলেও সেবার মান অত্যন্ত নাজুক এবং কর্তৃপক্ষও ঠিকমত নেটওর্য়াকিং সুবিধা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শুধু নামেমাত্র এই সুবিধা পাচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, স্পিড অত্যন্ত কম এবং প্রায় সময়ই সংযোগ থাকে না।

কেবল ব্রডব্যান্ড
কম্পিউটারের সঙ্গে সরাসরি কেবল ব্যবহার করা ইন্টারনেট সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় এবং দ্রুতগতির ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় খরচ কম। বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকের থেকে বেশি গ্রাহককে সংযোগ দেয়ায় গতি কমে যায় এবং উন্মুক্তভাবে কেবল নেয়ায় যে কোনো সময় লাইন বিচ্যুত হতে পারে। যারা ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তাদের জন্য সার্বক্ষণিক ব্যবহারের নিশ্চয়তা পাওয়া কঠিন।

ডায়াল-আপ
ডায়াল-আপ ইন্টারনেট বর্তমানে প্রায় নেই। এজন্য টেলিফোন সংযোগ এবং কোনো আইএসপির সেবা নেয়া প্রয়োজন হয়। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই এটা ব্যবহার করেন।

সাবমেরিন কেবলে প্রায়ই সমস্যা
সাবমেরিন কেবলস্ মেরামতের কারণে বাংলাদেশে প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যখন তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না ব্যবহারকারীরা। এতে বাংলাদেশ বলা যায় বিশ্বের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগবিহীন অবস্থায় থাকছে। আর সাবমেরিন কেবলের সংস্কার কাজ চালানোর সময় - দিন পুরো সময় ধরেও ইন্টারনেট যোগাযোগ থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন থাকছে। তবে আশার খবর হলো, আরও একটি সাবমেরিন কেবল বসানোর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।

আউটসোর্সিংয়ে সমস্যা বাড়ছে
আউটসোর্সিং এখন শুধু একটি সম্ভাবনাময় বিষয় নয়, বরং অনলাইনে ঘরে বসে আয়ের চলমান একটা বড় উত্সও বটে। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্টারনেটে স্পিড দ্রুত না থাকা সংযোগে সমস্যা থাকায় ব্যবহারকারীরা নানা বিপত্তিতে পড়ছেন। খাতে সংশ্লিষ্টরা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের লোকজনের কাছে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, তারা সময়মত কাজ ডেলিভারি দিতে পারছেন না। এতে তাদের অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

২০২০ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবে দুই কোটি
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে।টুওয়ার্ডস কানেক্টেড বাংলাদেশ সোশ্যিও-ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট অব ইন্টারনেট ইন বাংলাদেশ ইকনোমিশীর্ষক এই সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঠিক উদ্যোগ এবং নীতি অনুসরণ করলে ২০২০ সাল নাগাদ দেশ এমন একটা জায়গায় পৌঁছবে যেখানে প্রতি ১০০ বাসায় ১০ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী থাকবে। টেলিনর গ্রুপের জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করেছে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনও অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ইন্টারনেট প্রবেশ্যতাসম্পন্ন দেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা বাড়ানোর জন্য সরকার এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২০ সাল নাগাদ মোট জিডিপির . শতাংশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্জিত হবে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ভবিষ্যত্ কোন দিকে যাবে? ব্যাপারে দেশের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্টদেরই বা ভূমিকা কী?

Print this post

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন